।। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দঃ কবি ও সন্ন্যাসী।।
রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে বিবেকানন্দের সিমলার বাড়িটা খুব দূরে ছিল না। মাত্র দেড় কিলোমিটার। কিন্তু তাঁদের চিন্তার মধ্যে দূরত্ব ছিল।
রবির সঙ্গে নরেনের সম্পর্ক কেমন ছিল, সেটা সত্যি বলতে কী, খুব স্পষ্ট নয়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বীপেন্দ্রনাথের সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ, মানে বিবেকানন্দ। সেই সূত্রে যোগাযোগ। ভালো গানের গলা ছিল বিবেকানন্দের। তা ছাড়া ব্রাহ্মদের সম্পর্কেও আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই সূত্রে জোড়াসাঁকোর সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। প্রায় সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপও সেই সময় থেকেই।
তার পর অবশ্য দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে জড়িয়েছেন নরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন শান্তিনিকেতন।
১৯০২-এ মারা যান বিবেকানন্দ। সেই সময় তিনি যথেষ্ট বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথও। অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বিশেষ কিছু বলেননি। রবীন্দ্রনাথও তা-ই। পূর্বসূরি, সমসাময়িক, উত্তরসূরি অনেকের সম্পর্কেই অকাতরে মন্তব্য করেছেন রবি ঠাকুর। কিন্তু বিবেকানন্দের জীবদ্দশায় তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেননি রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য পরে সেটা তিনি পুষিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা হলেও।
তবে বিবেকানন্দ ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ভালোবাসতেন। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বিবেকানন্দ সম্পদিত গানের বইয়েও (‘সংগীত কল্পতরু’) রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান সংকলিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ ও অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন বিবেকানন্দ।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ ভালো কিছু বলেছিলেন, এমন পাকা প্রমাণ মেলে না। কিছু স্মৃতিকথা থেকে যা জানা যায়।
নিবেদিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে নরেন-রবি সাক্ষাৎও হয় দু’চার বার। কিন্তু দু’জনেই একে অপরের প্রতি নিষ্পৃহ ছিলেন বলেই সাক্ষ্য মেলে। বিবেকানন্দ ঠাকুর পরিবার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন শিষ্যা নিবেদিতাকে। অন্তত একটা লেখায় কিশোর রবীন্দ্রনাথের ‘মেয়েলি’ ভাব নিয়ে কটাক্ষও করেছিলেন বিবেকানন্দ। (‘পরিব্রাজক’) অথচ ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে’ রবি ঠাকুরের লেখা গানটা প্রিয় ছিল বিবেকানন্দের!
রোমা রোলার ‘ভারতবর্ষের দিনপঞ্জি’তে না কি একটা উক্তি আছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অবদান স্বীকার করেছেন বিবেকানন্দ।
অন্য দিকে, আমেরিকার ধর্ম মহাসভা থেকে ফেরার পর শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিবেকানন্দের সংবর্ধনা সভায় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় কিছু বলেছিলেন কি না, জানা যায় না। মিশনের বইতে কি কিছু আছে?
অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘রথের রশি’ নাটকে কবি ও সন্ন্যাসীর চরিত্র দুটো রবীন্দ্রনাথ জথাক্রমে নিজের এবং বিবেকানন্দের আদলেই গড়েছিলেন।
বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটা সভায় হাজির হয়ে বিবেকানন্দের প্রশংসা করেন। ভবানীপুরের একটা বড় আকারের শোকসভায় তিনি দীর্ঘ ভাষণ দেন। অথচ যে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দের লেখা, বক্তৃতা, স্মৃতি রক্ষায় নিখুঁত পেশাদারিত্ব সহ যত্নশীল, তারা বিবেকানন্দ সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কেন সেই পেশাদারিত্ব দেখাল না, বোঝা মুশকিল। (যদিও, মৃত্যুর পর শোকসভার ভাষণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত হয়। তাই প্রকৃত মনোভাব সেই বক্তব্য থেকে জানা সম্ভব নয়। আলগা চিঠিপত্রের ঘরোয়া, আটপৌরে আলোচনাতেই আসল মনোভাবটা জানা যায়। যা, রবি-নরেন সংক্রান্ত স্মৃতিকথায় অভাব আছে।)
মনে হয়, বিবেকানন্দকে শ্রদ্ধা করলেও তাঁকে যে রূপে রবীন্দ্রনাথ দেখতে চাইতেন, সেটা বাস্তবের সঙ্গে মিলত না। অনেকে মনে করেন, ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু ‘গোরা’র চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, বিবেকান্দ’কে ওইভাবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হত না। ফলে বিবেকানন্দ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে হয়তো একটা পরস্পরবিরোধী মনোভাব কাজ করত।
এমনও হতে পারে, বিবেকানন্দের ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদী’ ঝোঁক’টা উপনিষদের ঋষিসুলভ চোখ দিয়ে ‘ভারতের শাশ্বত ধর্ম’কে দেখা ‘বিশ্বকবি’র ভালো লাগত না।
sudip_moitra
রবির সঙ্গে নরেনের সম্পর্ক কেমন ছিল, সেটা সত্যি বলতে কী, খুব স্পষ্ট নয়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বীপেন্দ্রনাথের সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ, মানে বিবেকানন্দ। সেই সূত্রে যোগাযোগ। ভালো গানের গলা ছিল বিবেকানন্দের। তা ছাড়া ব্রাহ্মদের সম্পর্কেও আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই সূত্রে জোড়াসাঁকোর সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। প্রায় সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপও সেই সময় থেকেই।
তার পর অবশ্য দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে জড়িয়েছেন নরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন শান্তিনিকেতন।
১৯০২-এ মারা যান বিবেকানন্দ। সেই সময় তিনি যথেষ্ট বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথও। অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বিশেষ কিছু বলেননি। রবীন্দ্রনাথও তা-ই। পূর্বসূরি, সমসাময়িক, উত্তরসূরি অনেকের সম্পর্কেই অকাতরে মন্তব্য করেছেন রবি ঠাকুর। কিন্তু বিবেকানন্দের জীবদ্দশায় তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেননি রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য পরে সেটা তিনি পুষিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা হলেও।
তবে বিবেকানন্দ ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ভালোবাসতেন। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বিবেকানন্দ সম্পদিত গানের বইয়েও (‘সংগীত কল্পতরু’) রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান সংকলিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ ও অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন বিবেকানন্দ।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ ভালো কিছু বলেছিলেন, এমন পাকা প্রমাণ মেলে না। কিছু স্মৃতিকথা থেকে যা জানা যায়।
নিবেদিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে নরেন-রবি সাক্ষাৎও হয় দু’চার বার। কিন্তু দু’জনেই একে অপরের প্রতি নিষ্পৃহ ছিলেন বলেই সাক্ষ্য মেলে। বিবেকানন্দ ঠাকুর পরিবার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন শিষ্যা নিবেদিতাকে। অন্তত একটা লেখায় কিশোর রবীন্দ্রনাথের ‘মেয়েলি’ ভাব নিয়ে কটাক্ষও করেছিলেন বিবেকানন্দ। (‘পরিব্রাজক’) অথচ ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে’ রবি ঠাকুরের লেখা গানটা প্রিয় ছিল বিবেকানন্দের!
রোমা রোলার ‘ভারতবর্ষের দিনপঞ্জি’তে না কি একটা উক্তি আছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অবদান স্বীকার করেছেন বিবেকানন্দ।
অন্য দিকে, আমেরিকার ধর্ম মহাসভা থেকে ফেরার পর শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিবেকানন্দের সংবর্ধনা সভায় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় কিছু বলেছিলেন কি না, জানা যায় না। মিশনের বইতে কি কিছু আছে?
অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘রথের রশি’ নাটকে কবি ও সন্ন্যাসীর চরিত্র দুটো রবীন্দ্রনাথ জথাক্রমে নিজের এবং বিবেকানন্দের আদলেই গড়েছিলেন।
বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটা সভায় হাজির হয়ে বিবেকানন্দের প্রশংসা করেন। ভবানীপুরের একটা বড় আকারের শোকসভায় তিনি দীর্ঘ ভাষণ দেন। অথচ যে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দের লেখা, বক্তৃতা, স্মৃতি রক্ষায় নিখুঁত পেশাদারিত্ব সহ যত্নশীল, তারা বিবেকানন্দ সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কেন সেই পেশাদারিত্ব দেখাল না, বোঝা মুশকিল। (যদিও, মৃত্যুর পর শোকসভার ভাষণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত হয়। তাই প্রকৃত মনোভাব সেই বক্তব্য থেকে জানা সম্ভব নয়। আলগা চিঠিপত্রের ঘরোয়া, আটপৌরে আলোচনাতেই আসল মনোভাবটা জানা যায়। যা, রবি-নরেন সংক্রান্ত স্মৃতিকথায় অভাব আছে।)
মনে হয়, বিবেকানন্দকে শ্রদ্ধা করলেও তাঁকে যে রূপে রবীন্দ্রনাথ দেখতে চাইতেন, সেটা বাস্তবের সঙ্গে মিলত না। অনেকে মনে করেন, ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু ‘গোরা’র চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, বিবেকান্দ’কে ওইভাবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হত না। ফলে বিবেকানন্দ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে হয়তো একটা পরস্পরবিরোধী মনোভাব কাজ করত।
এমনও হতে পারে, বিবেকানন্দের ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদী’ ঝোঁক’টা উপনিষদের ঋষিসুলভ চোখ দিয়ে ‘ভারতের শাশ্বত ধর্ম’কে দেখা ‘বিশ্বকবি’র ভালো লাগত না।
sudip_moitra
No comments:
Post a Comment