Monday, September 3, 2018

রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিষ

বাল্য বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের। পরলোক চর্চা করেছেন, বিস্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে। খুব কৌতূহল ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে। বইও লিখেছেন 'বিশ্বপরিচয়' নাম দিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি কি জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন?

রবীন্দ্রনাথ ও নাস্তিকতা

রবীন্দ্রনাথ ও নাস্তিকতা...
কবি মূলত ভাববাদী ছিলেন, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে বাস্তব জগত সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না, সেটা বোঝা যায়, তাঁর নানা চিন্তা থেকে। ধর্মের সমালোচনা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি নিয়ে তিনি তো সরব হয়েছেনই, এমনকি তিনি বিশেষ অবস্থায় নিররীশ্বরবাদী দর্শনেরও প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দঃ কবি ও সন্ন্যাসী

।। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দঃ কবি ও সন্ন্যাসী।।
রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে বিবেকানন্দের সিমলার বাড়িটা খুব দূরে ছিল না। মাত্র দেড় কিলোমিটার। কিন্তু তাঁদের চিন্তার মধ্যে দূরত্ব ছিল।
রবির সঙ্গে নরেনের সম্পর্ক কেমন ছিল, সেটা সত্যি বলতে কী, খুব স্পষ্ট নয়।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বীপেন্দ্রনাথের সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ, মানে বিবেকানন্দ। সেই সূত্রে যোগাযোগ। ভালো গানের গলা ছিল বিবেকানন্দের। তা ছাড়া ব্রাহ্মদের সম্পর্কেও আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই সূত্রে জোড়াসাঁকোর সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। প্রায় সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপও সেই সময় থেকেই।
তার পর অবশ্য দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে জড়িয়েছেন নরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন শান্তিনিকেতন।
১৯০২-এ মারা যান বিবেকানন্দ। সেই সময় তিনি যথেষ্ট বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথও। অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ বিশেষ কিছু বলেননি। রবীন্দ্রনাথও তা-ই। পূর্বসূরি, সমসাময়িক, উত্তরসূরি অনেকের সম্পর্কেই অকাতরে মন্তব্য করেছেন রবি ঠাকুর। কিন্তু বিবেকানন্দের জীবদ্দশায় তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেননি রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য পরে সেটা তিনি পুষিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা হলেও।
তবে বিবেকানন্দ ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ভালোবাসতেন। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বিবেকানন্দ সম্পদিত গানের বইয়েও (‘সংগীত কল্পতরু’) রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান সংকলিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ ও অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন বিবেকানন্দ।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিবেকানন্দ ভালো কিছু বলেছিলেন, এমন পাকা প্রমাণ মেলে না। কিছু স্মৃতিকথা থেকে যা জানা যায়।
নিবেদিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে নরেন-রবি সাক্ষাৎও হয় দু’চার বার। কিন্তু দু’জনেই একে অপরের প্রতি নিষ্পৃহ ছিলেন বলেই সাক্ষ্য মেলে। বিবেকানন্দ ঠাকুর পরিবার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন শিষ্যা নিবেদিতাকে। অন্তত একটা লেখায় কিশোর রবীন্দ্রনাথের ‘মেয়েলি’ ভাব নিয়ে কটাক্ষও করেছিলেন বিবেকানন্দ। (‘পরিব্রাজক’) অথচ ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে’ রবি ঠাকুরের লেখা গানটা প্রিয় ছিল বিবেকানন্দের!
রোমা রোলার ‘ভারতবর্ষের দিনপঞ্জি’তে না কি একটা উক্তি আছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অবদান স্বীকার করেছেন বিবেকানন্দ।
অন্য দিকে, আমেরিকার ধর্ম মহাসভা থেকে ফেরার পর শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিবেকানন্দের সংবর্ধনা সভায় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় কিছু বলেছিলেন কি না, জানা যায় না। মিশনের বইতে কি কিছু আছে?
অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘রথের রশি’ নাটকে কবি ও সন্ন্যাসীর চরিত্র দুটো রবীন্দ্রনাথ জথাক্রমে নিজের এবং বিবেকানন্দের আদলেই গড়েছিলেন।
বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটা সভায় হাজির হয়ে বিবেকানন্দের প্রশংসা করেন। ভবানীপুরের একটা বড় আকারের শোকসভায় তিনি দীর্ঘ ভাষণ দেন। অথচ যে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দের লেখা, বক্তৃতা, স্মৃতি রক্ষায় নিখুঁত পেশাদারিত্ব সহ যত্নশীল, তারা বিবেকানন্দ সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কেন সেই পেশাদারিত্ব দেখাল না, বোঝা মুশকিল। (যদিও, মৃত্যুর পর শোকসভার ভাষণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত হয়। তাই প্রকৃত মনোভাব সেই বক্তব্য থেকে জানা সম্ভব নয়। আলগা চিঠিপত্রের ঘরোয়া, আটপৌরে আলোচনাতেই আসল মনোভাবটা জানা যায়। যা, রবি-নরেন সংক্রান্ত স্মৃতিকথায় অভাব আছে।)
মনে হয়, বিবেকানন্দকে শ্রদ্ধা করলেও তাঁকে যে রূপে রবীন্দ্রনাথ দেখতে চাইতেন, সেটা বাস্তবের সঙ্গে মিলত না। অনেকে মনে করেন, ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু ‘গোরা’র চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, বিবেকান্দ’কে ওইভাবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হত না। ফলে বিবেকানন্দ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে হয়তো একটা পরস্পরবিরোধী মনোভাব কাজ করত।
এমনও হতে পারে, বিবেকানন্দের ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদী’ ঝোঁক’টা উপনিষদের ঋষিসুলভ চোখ দিয়ে ‘ভারতের শাশ্বত ধর্ম’কে দেখা ‘বিশ্বকবি’র ভালো লাগত না।
sudip_moitra

প্রসঙ্গঃ অটলবিহারি বাজপেয়ী

প্রসঙ্গঃ অটলবিহারি বাজপেয়ী
অটলবিহারি বাজপেয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন কি না, কিংবা তিনি ব্রিটিশের গুপ্তচর ছিলেন কি না, জানি না। কিন্তু এটা বেশ মনে করতে পারি যে, বাবরি মসজিদ ভাঙার ‘আন্দোলন’এ তাঁর ভূমিকা এল কে আদবানি, অশোক সিংঘল বা উমা ভারতীদের চেয়ে কিছু কম ছিল না।
বাবরি ভাঙার কথা উঠলেই নরসিমহা রাও (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী), কল্যাণ সিং (উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী), অশোক সিংঘল (বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান), আদবানি, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার প্রমুখকে নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বাদ পড়ে যান অটলবিহারি বাজপেয়ী। অথচ রামমন্দির আন্দোলনের শুরু থেকেই বাজপেয়ী ছিলেন প্রথম সারিতে। ওই আন্দোলনে আদবানি-সিংঘল স্ট্রাইকার, উমা-বিনয়’রা উইংগার হলে, বাজপেয়ী ছিলেন মিডফিল্ডার, স্কিমার। আদবানিরা গোল করেছেন। কিন্তু একটু নীচে থেকে খেলাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। রথযাত্রায় আদবানি ছাড়া অন্য কাউকে মানাত না। যেমন ‘নায়ক’-এ উত্তমকুমারের জায়গায় অনুপকুমার থাকলে ছবিটা জমত না! আসল কৃতিত্ব কিন্তু সত্যজিতের।
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি ভাঙা হয়। তার আগে বেশ কয়েক দিন ধরে অকুস্থলে লাগাতার সভা-সমাবেশ করেছিলেন বিজেপি ও সংঘ পরিবারের তাবড় নেতানেত্রীরা। বাজপেয়ীও ছিলেন আগাগোড়া, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ৫ ডিসেম্বর লখনউয়ের কাছে আমিনাবাদের ঝান্ডেওয়াল পার্কের সমাবেশে তাঁর বক্তৃতা শুনুনঃ
“...এমন কি, সুপ্রিম কোর্টও করসেবা বন্ধ করতে পারবে না। সত্যি বলতে কী, আদালতই আমাদের করসেবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে। অযোধ্যা য় করসেবা করলে আমাদের আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে না। বরং করসেবা করলেই শীর্ষ আদালতের রায়কে মান্যতা দেওয়া হবে।
লখনউ বেঞ্চের রায় বেরোনোর আগে পর্যন্ত কোর্ট আমাদের নির্মাণকাজ করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু তারা বলেছে, আমরা সেখানে ভজন, কীর্তন করতে পারি। ভজন এক জনে করা যায় না। অনেকে মিলে করতে হয়। কীর্তন করতে তো আরও বেশি লোক লাগে। এবং ভজন-কীর্তন দাঁড়িয়ে করা যায় না। বসে করতে হয়। কিন্তু জায়গাটা তো সূচালো পাথরে ভরা, সেখানে বসে কিছু করতে গেলে আগে জমিটা সমান করতে হবে। যজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। যজ্ঞ করার জন্য আমাদের একটা বেদি বানাতে হবে।... কাল যে কী হবে, আমি জানি না...। আমি অযোধ্যাতেই যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে দিল্লিতে যেতে বলা হয়েছে।” লিবারহান কমিশন এই বক্তব্যকে উসকানিমূলক বলে অভিযুক্ত করেছিল বাজপেয়ীকে। ঠিকই করেছিল। কিন্তু বাজপেয়ীর যুক্তি ছিল, ‘হালকা চালে বলেছিলাম। উসকানি তো কিছু ছিল না...।” আপনাদেরও কি তা-ই মনে হয়, বন্ধুরা?
সেই সময় বাবরি মসজিদ ভাঙার জমি তৈরি করার জন্য এক দিকে যেমন একটানা উসকানিমূলক ভাষণ চলছিল, অন্য দিকে তেমনই ইমারত ভাঙার প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছিল করসেবক’দের।
বিবিসি’র রিপোর্ট কী বলছে, দেখা যাক।
বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রস্তুতি চলছিল আগে থেকেই এবং ঘটনার আগের দিন একদল হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক এটির 'ড্রেস রিহার্সেল' দিয়েছিল। আলোকচিত্র সাংবাদিক প্রভীন জৈন ছবি তোলার জন্য এই হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকদের অনুসরণ করছিলেন। সেদিনের ঘটনার অনেক ছবিও তুলেছেন তিনি। প্রভীন জৈন বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন সেদিনের ঘটনাবলী: “আমি অযোধ্যা এসে পৌঁছাই ১৯৯২ সালের ৪ ডিসেম্বর। সেই সন্ধ্যায় অযোধ্যা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। আমি তখন 'দ্য পাইওনীয়ার' পত্রিকায় কাজ করি। তারা আমাকে এই অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়েছে। হিন্দু কর সেবক এবং উগ্রপন্থী হিন্দু নেতাদের যে দলটি বাবরি মসজিদ চত্ব্বরে সমবেত হবে, আমাকে তাদের ছবি তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হাজার হাজার কর্মী তখন সেখানে জড়ো হয়েছে। এই দলটি ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ভারতে যে সব হিন্দু দল এবং গোষ্ঠী সক্রিয়, তাদের আদর্শগত নেতৃত্বে আছে এই আরএসএস। এসব দলের মধ্যে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিও, যারা এখন ভারতের শাসনক্ষমতায়। হিন্দু গোষ্ঠীগুলো মনে করে বাবরি মসজিদ যেখানটায় তৈরি করা হয়েছে, সেটি আসলে হিন্দু দেবতা রামের জন্মভূমি। মসজিদের কাছে তারা একটি হিন্দু মন্দির তৈরির পরিকল্পনা করছিল। হিন্দু নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন তারা মসজিদ স্পর্শ করবেন না। আর তাদের কর্মসূচী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং সেখানে একটি ধর্মীয় প্রার্থনা আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। একজন বিজেপি এমপির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, ৫ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার একটা মহড়া হবে। তিনি আমাকে আরও জানিয়েছিলেন, শীর্ষ নেতারা তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এই মহড়ায় যেন সাংবাদিকরা কোনভাবেই হাজির থাকতে না পারে। তিনি আমাকে বললেন,"তবে আপনি আমার বন্ধু এবং আমি আপনাকে বন্ধু হিসেবে এই তথ্যটা দিলাম।”
“আমি তখন ছদ্মবেশে এই হিন্দু করসেবকদের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমার মাথায় পট্টি বাঁধা, গায়ে গেরুয়া রঙের স্কার্ফ। জ্যাকেটের গায়ে সাঁটা একটা ব্যাজ, যা দেখে সবাইকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হবে। মসজিদের অল্প দূরেই একটা ফুটবল মাঠের সমান একটা জায়গায় সবাই জড়ো হচ্ছিল। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। হাজার হাজার মানুষ তখন সেখানে জড়ো হয়েছে যাদের সবার মাথায় পট্টি বাঁধা এবং গায়ে গেরুয়া বসন। ব্যাজ পরা হিন্দু করসেবকরা পুরো জায়গাটি ঘিরে রেখেছে। যে আমাকে সেখানে ঢুকতে সাহায্য করেছিল, সে আমাকে বলেছিল, একমাত্র এভাবেই আপনি এই মহড়ার ছবি তুলতে পারবেন। "আমার কাছাকাছি থাকুন, অন্য করসেবকদের মতো শ্লোগান দিন, ওদের সঙ্গে মিশে যান। এতে করে আপনি নিরাপদও থাকবেন।" তবে আমি হঠাৎ দেখলাম একটা মোটাসোটা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ক্যামেরা বন্ধ করতে বলছে। আমি আমার বুকে লাগানো ব্যাজ দেখিয়ে আর সবার মতো জোরে জোরে শ্লোগান দিতে থাকলাম। তখন লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে দাঁড়ানো একদল মানুষের কাছে যেতে ইঙ্গিত করল। কিন্তু আমি আমার ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমার সামনে তখন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলেছে। শাবল, কুড়াল, বেলচা এবং লোহার রড নিয়ে তখন লোকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা এক বিরাট মাটির ঢিবি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে। সবকিছুই ঘটছিল খুব পরিকল্পিত এবং সুচারুভাবে। এদের দেখে মনে হচ্ছিল না তারা কেবল স্বেচ্ছাসেবক, যেভাবে পেশাদারী কায়দায় তারা কাজ করছিল তাতে মনে হচ্ছিল কিভাবে একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে ফেলতে হবে সেটা তারা ভালোভাবেই জানে।
ভারত সরকারের নিয়োগ করা যে লিবারহান কমিশন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তদন্ত করেছিল, ২০০৯ সালে তারা তাদের রিপোর্টে এই মহড়ার কথা উল্লেখ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, "কমিশনের কাছে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে বিতর্কিত এই কাঠামোটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য একটি মহড়া দেয়া হয়েছিল। কমিশনের কাছে এর কিছু ছবিও জমা পড়েছে। তবে এটি ভাঙ্গার জন্য কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল কিনা, তার নিশ্চিত প্রমাণ নেই। যদিও কিছু অবস্থাগত প্রমাণ এবং কিছু সাক্ষ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে করসেবকদের এটি ভাঙ্গার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।" আমি একটা লোকের ছবি তুলেছিলাম, যার মুখ রুমালে ঢাকা ছিল। সবার মধ্যে একমাত্র সেই তার মুখটি আড়াল করে রেখেছিল। মাটির ঢিবিটা যারা ধ্বংস করে সরিয়ে নিচ্ছিল, লোকটি চিৎকার করে তাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটি দক্ষিণপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীর নেতা গোছের বলে মনে হচ্ছিল তাকে। সেজন্যেই সে তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছিল না। মাটির ঢিবিটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলা হলো। হিন্দু করসেবকরা এরপর সোল্লাসে চিৎকার করতে লাগলো। আমি জ্যাকেটের মধ্যে আমার ক্যামেরা লুকিয়ে ফেললাম এবং সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি তখনো লোকজনের সঙ্গে শ্লোগান দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। আমিই হচ্ছি একমাত্র আলোকচিত্র সাংবাদিক, যে এই ঘটনার ছবি তুলতে পেরেছি।
পরের দিন বাবরি মসজিদের কাছেই একটি ভবনের চার তলায় আমরা সাংবাদিকরা অবস্থান নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাবরি মসজিদ দেখা যায়। সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির নেতারা যে সভামঞ্চ তৈরি করেছেন, সেটিও চোখে পড়ে। প্রায় দেড় লাখ হিন্দু করসেব সেখানে জড়ো হয়েছে। সেখানে থাকা পুলিশ পর্যন্ত করসেবকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। দুপুরের একটু পর জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠলো। যে পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মসজিদ ঘিরে রেখেছিল, তাদের বেষ্টনি ভেঙ্গে ফেললো জনতা। কিছু লোক আমরা যে ভবনে ছিলাম, তার চার তলায় উঠে এলো। তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালালো। ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেললো। কয়েক মিটার দূরেই যে মসজিদ ভাঙ্গার কাজ চলছে, সেটার কোন 'ফোটোগ্রাফিক' প্রমান যেন না থাকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হলো বাবরি মসজিদ। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার হোটেলে ফিরে এলাম।
ততক্ষণে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আমি চারিদিকে পুলিশের সন্ধান করছিলাম, যারা সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু লোকজন তখন দোকান বন্ধ করছে, বাড়ির দরোজায় খিল দিচ্ছে। জানালা বন্ধ করছে। যেদিন এভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, একজন হিন্দু হয়ে আমি সেদিন লজ্জিত বোধ করছিলাম। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তদন্ত করে যে 'লিবারহান কমিশন' তার সামনে আমি সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। এই মামলার শুনানি চলছে যে বিশেষ আদালতে, সেখানে এখনো মাঝে মধ্যে আমাকে ডেকে পাঠায় সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (সিবিআই)। ২৫ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, এখনো পর্যন্ত তাদের কারও সাজা হয়নি।” [প্রভীন জৈন এখন ভারতের 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকার এসোসিয়েট ফটো এডিটর। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসির অনসুয়া বসু।]
‘কোবরা পোস্ট’-এর স্টিং অপারেশনেও প্রমাণিত পরিষ্কার তথ্য মেলে যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা কোনও আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। পরিকল্পনামাফিকই ব্যাপারটা ঘটানো হয়েছিল। যার জেরে দেশব্যাপী দাঙ্গায় মৃত্যু হয় কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের।
কোবরা’র হুল বেঁধা থেকে কী জানা গিয়েছিল? দেখা যাক।
রামজন্মভূমি আন্দোলনের গবেষণাধর্মী ইতিহাস রচনার নামে কোবরাপোস্টের অ্যাসোসিয়েটেড এডিটর অযোধ্যা, ফয়জাবাদ, মথুরা, লক্ষ্ণৌ, মোরাদাবাদ, মুম্বই, গোয়ালিয়র-সহ ১১টি জায়গা ঘুরে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ২৩ জন নেতার সঙ্গে কথা বলেন৷
তাঁদের কথোপকথনের গোপন রেকর্ডিং-এর ভিত্তিতে দাবি করা হয়, ‘অপারেশন জন্মভূমি' নামে বাবরি মসজিদ ভাঙার ছক কষা হয়েছিল অনেক আগে থেকে।
ধ্বংসকাণ্ড যাতে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হয়, তার জন্য সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখার ৩৮ জন স্বেচ্ছাসেবককে বেছে নিয়ে তাঁদের ঐ কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে৷ ‘লক্ষ্মণ সেনা' নামে ঐ ৩৮ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মী৷ প্রথম চেষ্টায় যদি বাবরি মসজিদ ভাঙা না যায়, তাহলে দ্বিতীয় বিকল্প ছিল ডিনামাইট ব্যবহার করা৷ এই চক্রান্তের কথা জানতেন লালকৃষ্ণ আডবানি, উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং-সহ বিজেপির কিছু শীর্ষ নেতা৷ শুধু তাই নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও নাকি পরিকল্পনার কথা টের পেয়েছিলেন. কিন্তু ঠেকাবার কোনো কড়া পদক্ষেপ নেননি – এমনও অভিযোগ করা হয়৷
এই প্রসঙ্গে এক উর্দু সংবাদপত্রের সম্পাদক মনে করেন, বাবরি মসজিদ এমন প্রযুক্তিতে তৈরি, যা ধ্বংস করা সাধারণ লোহার রড, শাবল, কোদাল, গাঁইতির দ্বারা সম্ভব নয়৷ ব্যবহার করা হয়েছিল কম শক্তির বিস্ফোরক, যার জন্য দরকার হয়েছিল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞের৷
এত কিছু পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ড, প্রশিক্ষণ— সব হয়েছিল দলের প্রতিষ্ঠাতা কাম শীর্ষনেতা কাম কাণ্ডারী অটলবিহারি বাজপেয়ীকে না জানিয়ে, তাঁকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে, অগোচরে? এটা কি মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে?
আমাদের অবশ্য এর উলটোটাই সত্যি বলে মনে হয়। অর্থাৎ, তিনি সব জানতেন শুধু নয়, রামমন্দির আন্দোলনের কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ-সংগীত এবং পরিচালনার অন্যতম মূল দায়িত্বই ছিল তাঁর। ওই ‘নায়ক’ সিনেমার মতোই— রামমন্দির আন্দোলনে আদবানি ‘উত্তমকুমার’ হলে বাজপেয়ী ছিলেন সত্যজিৎ!
রাম জন্মভূমিতে সেই যে সাম্প্রদায়িক হিংসার বীজ পোঁতা হল, তা থেকেই জন্ম হল বিষবৃক্ষের। আজ সেই গাছটাই ডালপালা মেলে গোটা ভারত ছেয়ে ফেলেছে। বিষের বলিও তো কম হচ্ছে না। এর দায় থেকে কি বাদ রাখা হবে বাজপেয়ীকে?

বাংলা সিরিয়ালের সমস্যা

ভয়াবহ পরিস্থিতি...
কেন বন্ধ বাংলা সিরিয়াল ? কী কী দাবি তুলেছেন কলাকুশলীরা ?
বাংলা বিনোদনের প্রত্যেকটি চ্যানেলেই আপাতত বন্ধ থাকছে সিরিয়াল৷ তবে জানা গিয়েছে, টাইমস্লট জিইয়ে রাখতে বেশিরভাগ সিরিয়ালের পুরনো এপিসড রিপিট হিসেবে দেখানো হবে ৷
কলকাতা: বন্ধ বাংলা সিরিয়াল ৷ টেলিভিশন জুড়ে সকাল থেকে বিকেল, সন্ধে থেকে রাত অবধি চলা একের পর সিরিয়ালে এবার ক্ষণিকের ইতি ৷ খবর অনুযায়ী, সোমবার বন্ধ থাকবে সিরিয়ালের সম্প্রচার ৷
এক নজরে কলাকুশলীদের দাবি--
১। প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বেতন
২। বকেয়া বেতন দিয়ে দিতে হবে
৩। শিল্পীরা সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা কাজ করবেন
৪। ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে ঘণ্টাপ্রতি টাকা
৫। ৩০ জুন পর্যন্ত বকেয়া টাকা মেটাতে হবে
বাংলা বিনোদনের প্রত্যেকটি চ্যানেলেই আপাতত বন্ধ থাকছে সিরিয়াল৷ তবে জানা গিয়েছে, টাইমস্লট জিইয়ে রাখতে বেশিরভাগ সিরিয়ালের পুরনো এপিসড রিপিট হিসেবে দেখানো হবে ৷
বকেয়া পারিশ্রমিকের দাবিতেই টানা তিন দিন ধরে টালিগঞ্জে বন্ধ রয়েছে বহু জনপ্রিয় মেগা সিরিয়ালের শ্যুটিং। রবিবার সমাধানের খোঁজে আর্টিস্ট ফোরাম এবং প্রযোজকরা বৈঠকও করেন। কিন্তু তাতেও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি । আর যার জেরেই রবিবারেও বন্ধ রয়েছে মেগা সিরিয়ালের শ্যুটিং।
আর্টিস্ট ফোরামের অভিযোগ অনুযায়ী, বেশ কিছু মেগা সিরিয়ালের অভিনেতাদের পারিশ্রমিক বকেয়া পড়ে রয়েছে। সেগুলি না মেটানো পর্যন্ত শ্যুটিয়ে অংশ নেবেন না কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রী।
আর্টিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে অভিনেতা–অভিনেত্রীদের জানানো হয়েছে, নির্দিষ্ট কল টাইমে মেকআপ করে শ্যুটিং ফ্লোরে গেলেও সহ অভিনেতা অভিনেত্রীদের বকেয়া পারিশ্রমিক না মেটা পর্যন্ত তাঁরা শ্যুটিং করতে পারবেন না। রবিবার এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে মুখোমুখি হয়েছিল আর্টিস্ট ফোরাম এবং প্রযোজকরা। কিন্তু তাতে কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। সেই সমাধানের খোঁজেই ফের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বৈঠক করবে প্রযোজকরা ৷ এমনকী, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ আর্টিস্ট ফোরামের সকল সদস্যদের নিয়ে বৈঠকেও বসার কথা রয়েছে ৷
তবে এই ঘটনা প্রথম নয়, গত মাসেও বাংলা সিরিয়ালের শিল্পী সংগঠন বা আর্টিস্ট ফোরামের সদস্যের প্রতিবাদের জেরে বন্ধ ছিল সিরিয়ালের শ্যুটিং ৷ তাঁদের অভিযোগ গভীর রাত পর্যন্ত শ্যুটিং চলে। কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কাজের সময় বেঁধে দিতে হবে। এরকম একগুচ্ছ দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছে তারা। এই নিয়ে প্রযোজকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে শিল্পীদের সংগঠন।
---
কৈফিয়ত-১।।
সিরিয়ালের গুণমান এখানে বিবেচ্য বিষয়ই নয়। আসল সমস্যাটা শ্রমের, শ্রমিকের, মজুরির। ‘খাটছি অথচ পয়সা পাচ্ছি না’— সমস্যা বলতে এটাই। সিরিয়ালের বিষয়বস্তু কী হবে, তা অভিনেতা-অভিনেত্রী তো কোন ছাড়, এমনকী, পরিচালকেরও হাতে থাকে না, প্রায়শই।
আর সিরিয়াল বন্ধ হলে? তখন বিজ্ঞাপন দেখার জন্য কি লোকে বসে থাকবে টিভির সামনে? বিজ্ঞাপন দেখাতে হলে সিরিয়াল চালাতে হবে। তা ছাড়া কালো টাকা সাদা করার চাপ আছে।
সিরিয়াল কেন ভালো হয় না, তার কারণ অনেক এবং তর্কটাও একেবারেই আলাদা। আর শুধু সিরিয়াল ভালো হয় না, তা তো নয়। ক’টা সিনেমা, নাটক, গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রতিবেদন ভালো হয়? ক’টা খেলা ভালো হয়? ক’টা দল, সংস্থা, রাজনৈতিক সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভালো হয়? ক’টা সম্পর্ক, প্রেম, সংসার, চাকরি ভালো হয়? ক’টা মন্ত্রী, আমলা, সরকার, ডাক্তার, মিস্তিরি, কাজের লোক, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু ভালো হয়?
আসলে ভালো-মন্দের ওপর কিছু নির্ভর করে না। ব্যাপারটা লাভজনক কি না, এটাই আসলি বাত। অনেক টি আর পি থাকা সত্ত্বেও সিরিয়ালগুলো যথেষ্ট মুনাফা নিশ্চয়ই দিচ্ছে না। তাই খরচ কাটছাট। আর সব শিল্পের মতো এই বিনোদন শিল্পেও সবার আগে কোপ শ্রমিক কলা-কুশলীদের ওপরই। আশ্বিনের শারদপ্রাতে যতই গলা কাঁপাও, যতই মঞ্চ আলোকিত করো না কেন— হে কলাকুশলী, শিল্পী— আদতে তুমি শ্রমিক, কর্মচারী। তোমার ওজনও সেই দাঁড়িপাল্লাতেই হবে, যেখানে কিছুক্ষণ আগে তোলা হয়েছিল কোনও বিড়িশ্রমিক বা পাথর খাদানের কর্মচারীকে!
---
কৈফিয়ত-২।।
একটা ভালো নাটক সিনেমা বা সিরিয়াল বানাতে এক জন প্রতিভাবান লোকের লাগে প্রয়োজনীয় মালমশলা, টাকা আর বক্তব্য প্রকাশের পরিসর। সেটা কি আছে?
ধরা যাক, কেউ মনে করল সে নিজের টাকাতেই ছবি বানাবে। বাস্তবকে তুলে ধরবে শিল্পের আঙ্গিকে। ছবে বানানো হবে সুভাষ চক্কোত্তির ‘অপারেশন সানশাইন’, নন্দীগ্রামে জমির লড়াইয়ের অন্তরালে, কিষেণজির সান্ধ্য ফোন-ইন এবং মৃত্যু, ছত্রধর মাহাতের উত্থান-পতন, কিংবা টলিউডে বাংলা সিরিয়াল কী ভাবে তৈরি হয়, পরিচালক-অভিনেতা অভিনেত্রীদের একদিন-প্রতিদিন, ভারত সেবাশ্রম, মাদার টেরেজা, মাদ্রাসা বা মুসলিম সেমিনারি ও সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর বা রামকৃষ্ণ মিশনের সমাজসেবার অজানা গপ্পো, কাশ্মীরে সেনা অভিযান, মণিপুরে থাংসাম মনোরমার দিনলিপি, এক বাস ড্রাইভার বা কনডাক্টরের সারাদিন, ডুয়ার্সে জঙ্গল সাফ ও কাঠ পাচার, উন্নয়নের নামে কংক্রিটের সমাজ, শিল্পের নামে বিদেশ সফর, ছত্তিশগড়ে মাও’রাজ, বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ, তিরুপতি কিংবা পদ্মনাভ মন্দিরের সোনাদানা, ধর্ম ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বিষয়আশয়, জীবনযাত্রা— ইত্যাদি হরেকরকম্বা বিষয় নিয়ে। চালু ব্যবস্থায় করা যাবে কি— এসব সিরিয়াল সিনেমা ডকুমেন্টারি? কী মনে হয়?

প্রসঙ্গঃ দেবব্রত বিশ্বাস

।। প্রসঙ্গঃ দেবব্রত বিশ্বাস।।
(২২ অগস্ট ১৯১১ – ১৮ অগস্ট ১৯৮০)
"জর্জ (দেবব্রত বিশ্বাস) তখন দাড়ি রাখছেন। গেরুয়া লুঙ্গি, ফতুয়া। হাতের লাঠিটা সর্বক্ষণের সঙ্গী। রোগ-জর্জর শরীর নিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বাইরে আকাশ দেখছেন। উত্তমকুমার এলেন শিল্পী-সংসদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে। জর্জ বললেন, "আপনে আইছেন ক্যান? আমারে তো পুলিশ ডাকতে হইব?" অনেক করে উত্তম রাজী করালেন। জর্জ শর্ত দিলেন দুটি। বিজ্ঞাপনে 'দেবব্রত বিশ্বাস' লেখা যাবে না। লিখতে হবে 'এক বিতর্কিত শিল্পী।' আর মঞ্চেও তাই ঘোষণা করতে হবে। তাই হল। উত্তমকুমার মাইকে বললেন, এবার গান
শোনাবেন এক বিতর্কিত শিল্পী। পর্দা উঠে গেল,জর্জ গান শুরু করলেন।"
রবীন্দ্রসংগীত গায়ক ও শিক্ষক হিসেবেই পরিচিতি দেবব্রত বিশ্বাসের। কিন্তু তিনি ভারতের গণনাট্য আন্দোলনেরও অন্যতম পুরোধা ও একজন বিখ্যাত গণসঙ্গীত গায়কও বটে। রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারের অব্যবহিত পূর্বে জন্ম বলে তাঁর ডাকনাম রাখা হয় জর্জ। পরবর্তীকালে অনুরাগীমহলে তিনি জর্জ বিশ্বাস বা জর্জদা নামেও পরিচিত হন।
১৯২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজের একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ'কে দেখেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। প্রথম দর্শনেই প্রেম। সেই থেকেই রবীন্দ্রসংগীত পাকাপাকি ভাবে তাঁর গলায়।
১৯৬৪ সাল থেকে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ভঙ্গি নিয়ে তাঁর মতভেদ শুরু হয়। মতভেদ তীব্র হলে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াই বন্ধ করে দেন। ১৯৭১ সালের পর থেকে আর তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেননি। তাঁর শেষ রেকর্ড এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁরই রচিত ও সুরারোপিত একটি গান – “ক্যারে হেরা আমারে গাইতায় দিল না/আমি বুঝতাম পারলাম না/এই কথাডা তো ব্যাবাকের আসে জ়ানা/জ়াইন্যা হুইন্যাও কেউ কিসু রাও করে না।”
এই কারণে তথাকথিত সুশীলসমাজে বিশ্বভারতীও কম সমালোচিত হয়নি। ২০০১ সালে ভারতে রবীন্দ্ররচনার কপিরাইট বিলুপ্ত হলে তাঁর বহু অপ্রকাশিত ও অননুমোদিত গান প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতাতেই নিজের বাসভবনে মৃত্যু হয় দেবব্রত বিশ্বাসের। তাঁর আত্মজীবনী ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ থেকে তাঁর জীবন ও বিশ্বভারতীর সঙ্গে তাঁর মতভেদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
১৯৭৮ সালের ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রসদন চত্বরে আয়োজিত ‘কবিপ্রণাম’ অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাসের গান শোনার সুযোগ হয়েছিল। ওই একবারই। তখন তিনি খুব অসুস্থ। কী গেয়েছিলেন, মনে নেই। কিন্তু তখন থেকেই আমি তাঁর ফ্যান। (ওই অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কবিতা আবৃত্তিও শুনেছিলাম।)
(এখানে একটা পৃষ্ঠার কপি দেওয়া হল, যেখানে রবি ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে।)

প্রসঙ্গ রূপা গাঙ্গুলি

প্রসঙ্গঃ রূপা গাঙ্গুলি...
অভিনেত্রী কাম নেত্রী রূপা গাঙ্গুলি’কে যারা ট্রোল করছেন, তাঁদের উদ্দেশে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
প্রথমত, বিজেপি’র নেত্রী হিসেবে এবং সংঘের অনুগত হিসেবে রূপা যে মন্তব্য করেছেন, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কারণ, ‘এ পার’টা হিন্দুদের আর ‘ও পার’টা মুসলমান’দের— এটা না বলতে পারলে বিজেপি করা চলে না।
দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্বের ধারণাটা তৈরি করেছে এবং প্রচার করেছে আরএসএস। সাভারকার, হেডগাওয়ার, গোলওয়ালকার প্রমুখের গোলগোল লেখার সারসংকলন করে সুদর্শনরা ‘হিন্দুত্ব’ সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তা হলঃ
১। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভূমি’কে যারা পিতৃভূমি (খেয়াল করুন, মাতৃভূমি নয়) তথা পুণ্যভূমি বলে মনে করেন, তাঁরাই হিন্দু।
২। যারা রাম’কে দেবতা বা জাতীয় বীর নায়ক হিসেবে মেনে নেন, তাঁরা হিন্দু।
অর্থাৎ, যারা এই দুটো শর্ত মানেন না, তাঁরা হিন্দু নন।
তৃতীয়ত, ভারতবর্ষ হিন্দুর দেশ। এখানে একটি মাত্র হিন্দু সংস্কৃতি (পড়ুন, ‘হিন্দুত্ব)-ই চলবে। তার বাইরে যাহা বাহান্ন তাহাই ছাপ্পান্ন, অর্থাৎ যাহা বিধর্মী, তাহাই বহিরাগত।
হিন্দুত্বের এহেন মাপকাঠিতে ভারতবর্ষীয় মুসলমান, খ্রিস্টান’দের জন্ম এই ভূখণ্ডে হলেও তাঁরা ‘বহিরাগত’। কারণ, তাঁরা যদি ‘ধার্মিক’ হন, তা হলে এই দেশকে একাধারে ‘পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি’ হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। কেন না, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁদের ‘পুণ্যভূমি’ ভারতীয় ভূখণ্ডের বাইরে, জেরুজালেম কিংবা মক্কা-মদিনায়। ফলে তাঁরা কখনই ‘হিন্দু’ হতে পারবেন না।
আরএসএস-এর এই যুক্তি কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কাল্পনিক তত্ত্বের ওপর। সেটা হলঃ ভারতের ইতিহাস হল হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের সংগ্রাম। হিন্দুরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করে। কোন লড়াই? না, মহম্মদ ঘোরির সঙ্গে পৃথ্বীরাজ চৌহানের। বাবরের সঙ্গে সংগ্রাম সিংহের। আকবরের সঙ্গে রানাপ্রতাপের। ঔরংজেবের সঙ্গে শিবাজির।
ওই যুদ্ধগুলো হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তা কখনই হিন্দু বনাম মুসলমান ছিল না। ছিল দুই সাম্রাজ্যবাদী শাসকের লড়াই। ইতিহাসের তথ্য সে কথাই বলে। তবু তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা করে একটা মিথ বানানো হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘হিন্দুত্ব’-এর একটা তাত্ত্বিক ভিত।
মাধ্যমিকের পড়াশোনা আর সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকলে যে কেউ সঙ্ঘনেতাদের এই কুযুক্তি ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু সঙ্ঘের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা যে করছে, তাকে এটা মুখস্থ করতেই হবে। রূপা সেটা করেছেন। কেন না, স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করার পেশাদারি দক্ষতা তাঁর আছে। শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে তো বটেই, এমনকী, ‘প্রগতিশীল’ নামধারী মুসলমান সমাজেরও তো অনেককে দেখা যাচ্ছে ভুলভাল সংঘশিক্ষা অনায়াসে গলাঃধকরণ করতে, সহজপাচ্য না হওয়া সত্ত্বেও।
রূপা’কে ট্রোল করা তাই পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। তার চেয়ে চলুন, আরএসএস বিরচিত ও নির্মিত হিন্দুত্বের মিথ’টাকে ধসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
sudip moitra
https://www.youtube.com/watch?v=0M84jp2a7rI

পরিবেশঃ কেরালার বন্যার কারণ

সুন্দরী পশ্চিমঘাট, কেরালার মহাপ্লাবন এবং প্রফেসর মাধব গ্যাডগিলের হারানো দলিল
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে। রাজদণ্ড ও বণিকের মানদণ্ডের যৌথ আঁতাতের ফল কেরালার এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। লিখছেন অমিতাভ আইচ।
ভারতের পশ্চিমতট রেখা বরাবর রয়েছে এক আশ্চর্য পর্বতমালা, উপত্যকা আর কুয়াশা ঢাকা গভীর অরণ্যময়। কৃষিজমি, নদ-নদীময় এক প্রাকৃতিক ভূভাগ, ভৌগোলিকরা যাকে বলেন সহ্যাদ্রি বা পশ্চিমঘাট।
“প্রাকৃতিক দিক থেকে এ এক সুমহান ঐতিহ্য যা খালি উপমহাদেশের পশ্চিম ভাগকে রক্ষাই করে না, দাক্ষিণাত্যের প্রাণস্বরূপ গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী, নেত্রাবতী, কুন্তী, ভাইগাই এবং অসংখ্য ছোট বড়ো নদী ও জলধারার উৎসস্থল, ও এককথায় সমগ্র দাক্ষিণাত্যের জলের আধার আর বিপুল নিজস্ব উদ্ভিদ, প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে আন্তর্জাতিক ভাবে পৃথিবীর একটি সবচেয়ে গুরুত্ববহনকারী জৈববৈচিত্র্যর আাধার বা বায়োডাইভারসিটি হটস্পট হিসাবে চিহ্নিত। আর একারণেই তো ভারতের ইউনেস্কোর একাধিক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটও তো এখানেই। আরও যদি কাব্যিক ভাবে ভাবি, তবে যেতে হবে মহাকবি কালীদাসের কাছে। যিনি লিখেছেন, সহ্যাদ্রি এক পরমাসুন্দরী রমণী, অগস্থামালাই তাঁর মুখমণ্ডল, মহিমাময়ী আন্নামালাই আর নীলগিরি তাঁর দুই বক্ষযুগল, কটিদেশ কানাড়া ও গোয়া আর পদযুগল হল উত্তর সহ্যাদ্রি। সেই মোহমহীর ঘন সবুজ বসন আজ মলিন ও শতচ্ছিন্ন। ধনী ব্যবসায়ীদের লোভ আর ভোগের বাসনা তাকে করেছে লাঞ্ছিত ও অসুন্দর আর গরিব মানুষের নিত্য বেঁচে থাকার লড়াইয়ের আঁচড়ে তাঁর দেহময় ক্ষতচিহ্ন।”
হ্যাঁ, অনেকটা এমনভাবেই সহ্যাদ্রিকে তাঁর রিপোর্ট-এর মুখবন্ধে বর্ণনা করেছেন প্রফেসর গ্যাডগিল। সেই রিপোর্ট, যা অধুনা বহু আলোচিত অথচ প্রকৃত অর্থেই সরকারি দপ্তরের গড্ডালিকা প্রবাহ আর অর্থশক্তির কাছে বিকিয়ে যাওয়া সস্তা, নিচু রুচির রাজনীতির অলিগলিতে হারিয়ে যাওয়া এক অসামান্য বৈজ্ঞানিক দলিল, যা কিনা ‘রিপোর্ট অব দ্য ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল’ বা সংক্ষেপে ডব্লুজিইইপি (WGEEP) বলে খ্যাত (অথবা কুখ্যাত)।
গ্যাডগিল কমিটি
২০১০ সালের ৪ মার্চ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও ওই অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে, বহু জটিল, বহুমাত্রিক ও একাধিক রাজ্যের মধ্যে বিস্তৃত ভারতের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব এসব পর্যালোচনা করার জন্যে একটি অতি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান ব্যাঙ্গালুরুর ভুবনখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর সেন্টার ফর ইকোলজিকাল সায়েন্সেস বিভাগের স্বনামধন্য ভূতপূর্ব প্রধান, প্রফেসর মাধব গ্যাডগিল। আর সে কারণেই এই কমিটিকে গ্যাডগিল কমিটিও বলা হয়ে থাকে। পশ্চিমঘাট বাস্তুতন্ত্র নিয়ে সারাটা জীবন কাজ করে যাওয়া আরও বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ছিলেন সেই দলে। ছিলেন, অধ্যাপক রমান সুকুমার, অধ্যাপক ভি এস বিজয়ন, যিনি সালিম আলির ছাত্র ও সালিম আলি ইনস্টিটিউট-এর ডাইরেক্টর, ছিলেন প্রফেসর রেনি বর্জেস ও আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও কেন্দ্রীয় ও কেরালা সরকারের বায়োডাইভারসিটি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বন পরিবেশ দপ্তরের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক।
এসবের উদ্দেশ্য ছিল একটাই ভারতের পরিবেশ রক্ষা আইন বা Environmental Protection Act, 1986, মোতাবেক ও সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিগত রিপোর্টগুলি পর্যালোচনার মাধ্যমে পশ্চিমঘাটে একাধিক সংবেদনশীল বাস্তুতান্তিক এলাকা নির্ধারণ করা আর এর সবই হবে এলাকার সাধারণ মানুষ, গ্রামসভা সবার সাথে আলোচনা করে, দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া এবং সুদুরপ্রসারী পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে।
পরবর্তী কালে কমিটিকে গুন্ডিয়া ও আথিরাপিল্লি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও গোয়া অঞ্চলে নতুন করে কোনও খনিজ খনন প্রক্রিয়া বন্ধ করার ব্যাপারটাও পর্যালোচনা করতে বলা হয়।
এক যুগান্তকারী নতুন আলোর দিশা
২০১১ সালের ৩১ অগাস্ট, গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এটি একটি দীর্ঘ এবং যুগান্তকারী দলিল যা কখনই এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার মূল প্রতিপাদ্যগুলিতে আমরা নজর রাখব। গ্যাডগিল কমিটি পশ্চিমঘাটের সমস্ত রাজ্যগুলিকে বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার দিক থেকে যথাক্রমে বেশি থেকে কম এই ভাবে এক, দুই ও তিন, যথা ESZ1, ESZ2, ESZ3 এই তিন ভাগে ভাগ করার কথা বলে ( ESZ- Ecological Sensitive Zone) আর এগুলির মাথার উপর একটি নতুন ও কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থার প্রবর্তন করার প্রস্তাব দেয়। যার নাম হবে Western Ghat Ecological Authority বা সংক্ষেপে WGEA। তবে সংরক্ষিত অরণ্য যেমন জাতীয় উদ্যান, অভয়ারন্য ইত্যাদিগুলি এসবের বাইরে যেমন ছিল থাকবে। সমস্ত পশ্চিমঘাটের পরিবেশ, প্রকৃতি, ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, অর্থনীতি, সামাজিক গঠন, কৃষিকাজ, জৈব বৈচিত্র্য এসব দিক পর্যালোচনা করে এবং তৃণমূলস্তরের অসংখ্য আলোচনা সভা এবং সমস্ত প্রতিনিধি সভার সাথে কথা বলে, বহু নিজস্ব ফিল্ডভিজিটের মাধ্যমে গ্যাডগিল রিপোর্ট এই কাজের জন্য সামগ্রিক সামাজিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কাজ করার কথা বলে। এক কথায় সারা ভারতে সরকারি কাজে যেভাবে প্রিন্সিপাল অব এক্সক্লুশনের বা সাধারণ মানুষকে বাইরে রেখে ঔপনিবেশিককালের পদ্ধতির মাধ্যমে সব পরিকল্পনা রচনা করার কথা বলা হয় এই রিপোর্ট তার বিপরীত। গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টে এনভায়রনমেন্টাল গভর্নে‌ন্স-এর কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট-এর অন্তর্গত কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্সের কথা, এছাড়াও বলা হয়েছে এ কাজে গ্রামসভাগুলির ব্যপক অংশগ্রহণ, জৈব বৈচিত্র্য ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও গ্রাম পরিবেশ রক্ষা বাহিনী বানানোর কথা। আছে মাইনিং প্রকল্পের সোশাল অডিট-এর কথাও।
কোনও কোনও অঞ্চলে বছরে ৫০০০ মিমি বৃষ্টি হওয়া, দেশের বহু বিপন্ন ও এন্ডেমিক (শুধুমাত্র ওইখানেই পাওয়া যায়) প্রজাতির আধার সহ্যাদ্রির (গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট অনুসারে সহ্যাদ্রির ৫৩% চিরসবুজ বৃক্ষ, ৭৬% ফড়িং, ৪০% প্রজাপতি, ৪১% মাছ ও ৭৮% ব্যাঙ খালি সেখানেই পাওয়া যায়, অর্থাৎ এন্ডেমিক, আর এটা তার সব ধরনের জৈববৈচিত্র্য, অর্থাৎ অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, চাষের ফসল, গবাদি পশু, ফল, পানীয় এসব বিপুল সমাহারের একটি অংশমাত্র যা এককথায় এক বিপুল রত্নভাণ্ডার) পরিবেশকে রক্ষা করার জন্যে গ্যাডগিল কমিটি যে নির্দেশিকা দান করেছে তা এক কথায় পথপ্রদর্শক। এক থেকে তিন এই প্রতিটি ইকো সেনসিটিভ জোনে কীভাবে, কোন প্রকারে জল, নিকাশি, কৃষিকাজ, পশুপালন, ফরেস্ট্রি, মাছচাষ, জৈব বৈচিত্র্যর ব্যবহার, মাইনিং, পাথর খাদান ও বালি খাদান; লাল ও কমলা তালিকাভুক্ত শিল্প যেমন কয়লা চালিত বিদ্যুৎ, সবুজ ও নীল তালিকার অর্থাৎ কম দূষণকারী শিল্প, শক্তি, পরিবহন, পর্যটন, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও তার অধিকার – এসব কেমন ভাবে কোন জোনে হবে ও আদৌ হবে কিনা এবং কীভাবে হবে তার দিকনির্দেশ আছে এ রিপোর্টে।
কিন্তু গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল, বিশেষ করে ESZ1 ও ESZ2 অঞ্চলে বড়ো বাঁধ, জল বিদ্যুৎপ্রকল্প, সবধরনের মাইনিং, পর্যটনের জন্য তৈরি রিসর্ট, হাইরাইজ ও পরিবহনের উপর প্রতিবন্ধকতা লাগাতে বলে। ফলে কেরালা থেকে গোয়া পর্যন্ত এক বিশাল আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী কায়েমি শ্রেণির সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষের মঞ্চ গ্যাডগিল কমিটি নিজেই তৈরি করে। বন্ধ করতে বলা হয় আথিরাপিল্লি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
পশ্চিমঘাটের প্রাকৃতিক সম্পদকে সেখানকার কায়েমি ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর খপ্পর থেকে বার করে কৃষক ও গ্রামিক সভার অধিকারের আওতায় নিয়ে এসে তা রক্ষা করার প্রতিস্পর্ধার সিঞ্চন রয়েছে এই যুগান্তকারী দলিলের পাতায় পাতায়। ফল যা হওয়ার তাই হল।
গ্যাডগিল মুর্দাবাদ
গ্যাডগিল রিপোর্ট দিনের আলো দেখার সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কেরলে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস ও সিপিএম যৌথভাবে একে জনগণবিরোধী আখ্যা দিয়ে নানা জায়গায় বন্ধ ডাকে, প্রফেসর গ্যাডগিলের কুশপুতুল পোড়ানো হয়, চারিদিকে রটিয়ে দেওয়া হয় যে, এই রিপোর্টের নির্দেশ কার্যকরী হলে কেরালা ও এই অঞ্চলের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন হুমকিও দেওয়া হয় যে যারা এসব করতে এখানে আসবেন তাদের লাঠিপেটা করে তাড়ানো হবে। কেরালা বিধানসভায় সব রাজনৈতিক দলের যৌথ সভা করা হয় আর সেখান থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন যায় এই রিপোর্ট নাকচ করার জন্য। চাপে পড়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাশীল ইউপিএ সরকার রিপোর্ট নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটে। সবচেয়ে মজার, যে সাইরো মালাবার ক্যাথেলিক চার্চ ও বামপন্থীরা গরিব ও চাষিদের স্বার্থে কাজ করে তারা গ্যাডগিল কমিটি রিপোর্ট-এর সবচেয়ে বড় বিরোধী হিসাবে সামনে আসে। এর পিছনেও কায়েমি স্বার্থের হাতই দেখছেন গ্যাডগিল কমিটি রিপোর্টের অন্যতম প্রধান লেখক, সালিম আলি ইনস্টিটিউট অব অর্নিথোলজির ডিরেক্টর ও সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সদস্য ড: ভিএস বিজয়ন। তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষ ও গ্রামসভার হাতে ক্ষমতা দানের মাধ্যমে, পরিবেশ বান্ধব কৃষি ও প্রকৃতি অনুসরণ করে যে পরিকল্পনা করা হল, তাকে মানুষ ও জীবন-জীবিকার বিরোধী এ কথা বলে যারা লোক খেপাচ্ছে তারা আসলে মাইনিং, অবৈধ খাদান, বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের লবি। এরা শুধু পশ্চিমঘাটকেই শেষ করবে না, যে কৃষকদের আজ খেপাচ্ছে তাদেরকেও। তিনি এর প্রমাণও দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের কাছে চরম ভর্ৎসনার পর কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট পাবলিশ করে দেওয়া হলে (রিপোর্ট কোনও স্থানীয় ভাষায় তর্জমা করা হয়নি ফলে মানুষ যা শুনেছে সব লোক মুখে) যে প্রতিবাদ পত্র আসে তার অধিকাংশই লিখেছিল মাইনিং লবির লোকেরা। আর এখান থেকেই বোঝা যায় আসল ঘটনাটা কী।
শেষ পর্যন্ত প্রায় বাতিলের খাতায় চলে যায় গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট। মহাকাশ বিজ্ঞানী কস্তুরিরঙ্গনকে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আরও একটি রিপোর্ট বানায়, যা গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট কে অনেক লঘু করে দেখিয়ে পশ্চিমঘাটের সংরক্ষণের কথা বলে। তবে তার কাজও তেমন এগোয় না। বিস্মৃতির পথে হাঁটা দেওয়া গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমঘাটের জলাধার নদী ও বনধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয়ে প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল আর তার থেকে বাঁচবার উপায়ও। মানুষের লোভ ও কায়েমি স্বার্থ ও অশিক্ষা সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ যে মহা প্রলয়সৃষ্টিকারী বর্ষণ ও বন্যা কেরালাকে প্রায় ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে শত শত নরনারী, বৃদ্ধ, শিশুর জীবন শেষ করে দিল তার দায় কার? অবশ্যই, সেই সব রাজনৈতিক নেতারা আর চার্চের ধর্মপ্রাণ ফাদাররা, যাঁরা সে সময় এর বিরোধিতা করেছেন আর যাঁরা এখন কোটি কোটি টাকার ত্রাণ তহবিল সামলাতে ব্যস্ত। তাঁরা অবশ্য এর দায়ভার নেননি। নেবেনও না কোনওদিন।
প্রলয় শেষ হবার পর
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রফেসর মাধব গ্যাডগিল কেরালার অগাস্ট ২০১৮ জুড়ে ঘটে চলা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মনুষ্যকৃত বলেছেন এবং এর জন্য সরকারের ভুল পরিবেশ নীতি, বেআইনি খনন ও নির্মাণ কাজকে দায়ী করেছেন। ঘটনা হল বন্যা ও ভূমি ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্ত সবচেয়ে বেশি ESZ1 ও ESZ2, যার সংরক্ষণের উপর ও বিধিনিষেধের উপর এত জোর দেওয়া হয়েছিল WGEEP রিপোর্টে। প্রফেসর গ্যাডগিল বলেছেন এরকম ফল গোয়াকেও ভুগতে হবে। এবং WGEEEP রিপোর্ট অস্বীকার করার ফল আমরা সবাই হাতেনাতে পাব। তিনি সরকারগুলিকে এখনও সাবধান হয়ে পদক্ষেপ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সৌজন্য:
১) The Kasturirangan Report is a disaster for the Western Ghats
২) Kerala priests and politicians unite to oppose Gadgil report on Western Ghats
৩) Western Ghats Ecology Expert Panel – Ministry of Environment and Forests
৪) Kerala floods is man-made calamity: Madhav Gadgil – Kerala Floods News
লেখক একজন শিক্ষক ও পরিবেশপ্রেমী।
http://www.groundxero.in/2018/08/23/kerala-flood-madhav-gadgil-report/

কবিতা-১

তুমি কে হে...
মেয়েদের দাঁত বের করে
হ্যা হ্যা করে হাসতে নেই।
মুখ হাঁ করে খেতে নেই।
ব্রাশ করার পর
খ্যা খ্যা ওয়াক থু...
শব্দ তুলতে নেই।
বাইরে বেরোলে
টিফিন জলের বোতল
নিতে ভুলে গেলে
ক্ষতি নেই।
আই-লাইনার চিরুনি
টিশ্যুপেপার নিতে
যেন ভুলো না।
ওঃ!
কোমর দুলিয়ে নাচ?
তা-ও আবার
স্কুল চত্বরে
হিন্দি গানের সনে!
ছিঃ ছিঃ।
তা হলে
বেবুশ্যে মাগীর সঙ্গে
ভদ্দর ঘরের লেড়কির
কী তফাৎ রইল গো?
ছেলেদের হাতে সিগার
মুখে খিস্তি
প্রেমে পড়া সহকর্মীকে
টোন-টিটকিরি
ও সব একটু
হয়েই থাকে...
আফটার অল, ছেলে তো!
তাই বলে
মেয়েদেরও তাল মিলিয়ে
নাচতে হবে?
ছেলে-মেয়ে কি এক?
কী বললে?
বদ্ধ আঙিনায়
ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিসরে
সন্তানসম বাচ্চাদের সঙ্গে
তাৎক্ষণিক হইচই?
চুরি করে
শব্দ ছবি কেটে জুড়ে
জালিয়াতি?
তা হোক গে।
তবু তো শিক্ষিকা।
যা রটে
কিছু তো বটে।
সমাজের প্রতি
একটা দায়িত্ব আছে না?
কী বললেন?
মেয়েদের নাচের পাঠ
দিয়েছিলেন রবি ঠাকুর?
তাতে কী!
উনি তো সবেতেই
ফুট কেটেছেন।
তাই বলে কি
দেশের শাশ্বত ভাব, সংস্কৃতি
রসাতলে দিতে হবে!
শোনো বাপু,
যতই রবি রাম্মোহন বিদ্যেসাগর করো
সনাতন ভাবনার
চাদর’টা সরিয়ো না।

2
রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেছিলেন...
‘আধমরা’দের ‘ঘা মেরে’ জাগাতে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মানুষের কুসংস্কার, তার বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব কিংবা জীবনযাত্রায় নানা স্ববিরোধ ইত্যাদি নিয়ে তাকে হেয় করতে হবে বা খোঁচা মারতে হবে। মানুষকে ভালো না বাসলে, তাকে সচেতন করা যাবে না। জন-সচেতনতামূলক যে কোনও কর্মসূচিতে (তা যদি ফেসবুকের তুচ্ছ ‘পোস্ট’ও হয়) জনগণের প্রতি সহমর্মিতা পূর্বশর্ত হওয়া উচিত। প্রশ্ন তোলা, সমালোচনা করা চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু সেটা কখনই সৌজন্য’কে ছুটি দিয়ে নয়। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা’র আদর্শ আমজনতা’কে অসম্মান করার কথা বলে না। যে একটা সংস্কারের শেকলও ছিঁড়তে পেরেছে, তাকে অভিনন্দন জানাতে হবে, পাশাপাশি, উৎসাহিতও করতে হবে যাতে সে অন্য শেকলগুলোও ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। যে তা পারেনি, তাকেও বোঝাতে হবে। কিন্তু সে বা তারা কেন এখনও একটা বা সব ক’টা শেকল ছিঁড়তে পারল না, এই প্রশ্ন তুলে যারা নিজেদের যুক্তিবাদের জ্যাঠামশাই ভাবছে, আর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লোকজন’কে অপমান করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি করছে।
(আলিপুর দুয়ারের একটি স্কুলে শিক্ষিকাদের ব্যক্তিগত পরিসরে নাচ)

সালোয়ার ও শিক্ষিকা

সালোয়ার ও শিক্ষিকা...
শাড়ি কি শালীন পোশাক? না কি সালোয়ার-কামিজ?🤔
ধুতি- পাঞ্জাবি শালীন? না কি শুট-প্যান্ট বা জিনস?😏
আসলে এগুলো একেবারেই অবান্তর আলোচনা। এর চেয়ে হাঁসের পালক দিয়ে কান পালিশ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।😜
নগ্নতা নিয়ে মধ্যযুগীয় (ভারতে মধ্যযুগটা যে কী বিরক্তিকররকমের দীর্ঘায়িত! সুমিত সরকার কেন যে ফালতু 'আধুনিক ভারত'এর ইতিহাস লিখে সময় নষ্ট করতে গেলেন, কে জানে!😪) বদ্ধমূল ধারণা থেকে এই ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়।
একটা সোজা সত্যি কথা বলে ফেলা যাক। আদতে ‘সংস্কৃতি বিলাসী’রাই শালীনতা-অশালীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কৃষক-শ্রমিকের সংস্কৃতি কিন্তু এই প্রশ্ন তোলে না, যদি না তারা মধ্যবিত্ত মানসিকতার লোকজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
আমরা খাটাখাটনি করি বটে, কিন্তু আমরা মনের দিক থেকে শ্রমিক নই। আমাদের চিন্তা চেতনা মূল্যবোধের বেশিরভাগটাই, যাকে ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতি’ বলে, আমি যাকে ‘বিলাসী সংস্কৃতি’ বলছি (বুর্জোয়া শব্দটা এড়ানোর জন্য), তার দ্বারা আচ্ছন্ন। এই শ্রেণীটাই শালীনতা-অশালীনতা নিয়ে চর্চা করে। এই চর্চার মধ্যে একটা ঈর্ষা আছে। অনুচ্চারিত মনের কথাটা হলঃ ওই মেয়েটার যে পোশাক আমাকে প্রলুব্ধ করছে, সেই পোশাকে অন্যেরা কেন তাকে দেখবে? সে যদি কেবল আমার সামনে বেআব্রু হয়, তা হলে তা ‘প্রগতিশীলতা’। কিন্তু সবার সামনে হলে ‘অশ্লীলতা’।
তা হলে মেয়েরা মেয়েদের পোশাক নিয়ে ছুত্মার্গ দেখায় কেন? শালীনতার প্রশ্ন তোলে কেন? ওটা প্রভাব। পুরুষতন্ত্রের প্রভাব। মেয়েরাও পুরুষতন্ত্রের দ্বারা চালিত হয়। পুরুষতন্ত্রের প্রেক্ষিতে, মোদীর ভাষাতেই এক সময় কথা বলতেন ইন্দিরা গান্ধী। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গেও বিন্দুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গিগত তফাৎ নেই মমতার।
শালীনতা নিয়ে যে এত প্রশ্ন, তার আর একটা সোজা কারণ আছে। ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবসর আছে। বিপ্লবী থেকে প্রতিবিপ্লবী সব ধরনের সংস্কৃতি নিয়ে তারা চর্চা করে। কিন্তু মূলত তারা প্রতিনিধিত্ব করে ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতি’র। সেই জন্য তারা সুখ-দুঃখ, প্রেম-অপ্রেম, নিরাপত্তা-বিপন্নতা, এলআইসি-এমআইএস, সুদের হার-পিএফ, অ্যান্ড্রয়েড-জিপিএস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনায় কালক্ষেপ করে। করতে পারে।
মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে পাথর খাদান বা ইটভাটার শ্রমিক, মাঠের কৃষক কিংবা বনবাসী মানুষের মধ্যে এই তর্ক ওঠে না।
যাক। এখানেও সেই জ্ঞানদা জ্ঞানদা ব্যাপার হয়ে গেল...😜

২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রসঙ্গঃ গীতা

প্রসঙ্গঃ গীতা
রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের আগে ‘ভগবদ্গীতা’ বলে কোনও ‘গ্রন্থ’ দুনিয়ার কোত্থাও ছিল না। না সংস্কৃত, না বাংলা বা ইংরেজি কোনও ভাষাতেই নয়। মহাভারতের অংশ হিসেবে ‘কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন’ অবশ্য ছিল। কিন্তু আলাদা করে তার গুরুত্ব ছিল না।
গীতার জন্মদাতা চার্লস উইলকিন্স। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহে তিনি সংস্কৃত পুঁথি ঘেঁটে মহাভারতের আংশিক অনুবাদ করেন ইংরেজি ভাষায়। সেই আংশিক ইংরেজি পাণ্ডুলিপি ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে এলে তিনি কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনটুকু আলাদা করে একটা বইয়ের পরিকল্পনা করেন। এই বক্তব্যের সঙ্গে খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসের নাকি খুব মিল ছিল। এই ভাবেই হেস্টিংস-উইলকিন্স যুগলবন্দিতে জন্ম হয় ‘ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী’ ‘শ্রীমদভগবদ্গীতা’র।
চার্লস উইলকিন্স ১৭৪৯ সালে ব্রিটিশ মুলুকের সমারসেটে জন্মেছিলেন। ১৭৭০ সালে ভারতে আসেন তিনি। টাইপিস্ট ও অনুবাদক হিসেবে যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র প্রেসে। দেবনাগরী লিপি ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল বলে শোনা যায়। ১৭৮৬ পর্যন্ত ছিলেন এ দেশে। তার মধ্যেই উইলিয়াম জোনসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করেন এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৭৮৪ সালে। পরে সদস্যও হন ব্রিটিশ রয়াল সোসাইটির। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ছিল চার্লস উইলকিন্সের।
চাকরির সূত্রে তিনি বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা শিখেছিলেন। বারাণসীতে থাকাকালীন তিনি জনৈক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কালীনাথের সাহায্যে মহাভারত অনুবাদ করেন, যদিও তা শেষ করে যেতে পারেননি। ওই আংশিক অনুবাদে মধ্য থেকে একটা অংশ আলাদা করে ঝাড়াইবাছাইয়ের পর ১৭৮৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়ঃ “Dialogues of Kreeshna and Arjoon” যা পরে “Bhagvat-geeta” নামে প্রচারিত হয়। এর পর জার্মান, ফ্রেঞ্চ বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিত হয়। বাংলায় অনুবাদও হয় চার্লস উইলকিন্সের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকেই। বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ উইলকিন্সের অনুবাদ থেকেই ‘গীতাভাষ্য’ লিখেছিলেন, এটা নিশ্চিত।
‘গীতা’কে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। এই ‘বই’কে পাঠ্য করার কথা শোনা যায়। মাঝেমধ্যে জাতীয় গ্রন্থ করার কথাও ওঠে। সে সব করার সময় ‘গীতা’র প্রকৃত ইতিহাসটাও পাঠ্যে রাখার কথা ভাবা হবে তো?
sudip moitra

৩।৯।১৮